বছরে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ৭শ' কোটি টাকা কর ফাঁকি

Picture

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছে। ১৮টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের ১৫টি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশ থেকে এ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইডের অপচুক্তি নামে এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের ওপর একশনএইড শনিবার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে 'দুর্বিনীত কর-আঘাত, অসমর্থিত বাজেট' শিরোনামে এক আলোচনার আয়োজন করে। আলোচনা শুরু হয় একশনএইডের ওই প্রতিবেদনের ফলাফল তুলে ধরার মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক 'অপচুক্তি' করিয়ে কর ফাঁকি দিচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পুনরায় বিনিয়োগের কথা থাকলেও করপোরেটরা লাভকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এ দেশ থেকে মুনাফা নেওয়ার পাশাপাশি ফাঁকি দেওয়া করের টাকাও নিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

 


প্রতিবেদন নিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'করপোরেট করের মতো প্রত্যক্ষ কর আদায়ে আমরা খুব বেশি চতুর ও দক্ষ হতে পারিনি। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে আমাদের সুযোগ দিতে হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের যতটা কঠোর ও কৌশলী হওয়া উচিত ছিল সেটা আমরা হতে পারিনি।'

অনুষ্ঠানে গবেষণাটি তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ডিরেক্টর আজগর আলী সাবরি। গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশে বাজেট, উন্নয়ন ও নীতিতে কী প্রভাব ফেলছে তাও তুলে ধরা হয়। গবেষণায় ৫ শতাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে সমীক্ষা করা হয়। যেখানে দেখা যায়, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৮টি 'অপচুক্তি' আছে এবং বেশি কর ফাঁকি হচ্ছে। চুক্তিগুলোর একটি ধারার কারণে বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের টাকার ওপর কর নিতে বাংলাদেশের ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। কর ফাঁকির এ টাকা দিয়ে প্রতিবছর ৩৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যেত বাংলাদেশে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক কোম্পানিগুলো তাদের কর দেওয়ার সময় হওয়ার আগে যেন আয় স্থানান্তর না করে সে বিষয়টি 'উইথহোল্ডিং কর' নিশ্চিত করে। অনেক করচুক্তি নিম্ন আয়ের দেশগুলোর এই অধিকারের মুখ বন্ধ করে দেয়, যেন করারোপের বিষয় না আসে। ফলে উৎস দেশগুলোতে কোনো অবদান রাখার আগেই বৈদেশিক বিনিয়োগের মুনাফা চলে যায় তাদের আবাসিক দেশে।

প্রতি বছরই মালিকের ডিভিডেন্ট বা পে-আউট দেশের বাইরে চলে যায়। করচুক্তি নির্ধারণ করে যে উৎস দেশগুলো এর ওপর করারোপ করতে পারবে কি-না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুক্তিগুলো এমনভাবে হয় যে এই করারোপ আংশিক বা কোনোভাবেই করা যায় না। কর চুক্তিগুলো এ ক্ষেত্রে অধিকার ক্ষুণ্ন করে।

ঋণের সুদের মাধ্যমেও মুনাফা স্থানান্তর হয়ে যায়। পেশাগত সার্ভিস ফি এক কোম্পানি আরেক কোম্পানিকে দেয়; অনেক সময় একই গ্রুপের মধ্যে হয়। সমস্যা তৈরি হয় যখন এই ফি দেওয়া হয় মুনাফা কমানোর জন্য। পুঁজির অর্জনের ওপর আরোপিত কর প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, 'আমাদের সক্ষমতার অভাবে করপোরেটরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। আমরা বলছি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সেটা করতে গিয়ে আমরা যদি তাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিই, সেটা যৌক্তিক নয়। আমাদের গরিব মানুষের সুবিধা বাড়াতে হবে কর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে।'

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, 'আশির দশকে আমাদের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার ছিল। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে আনতে হয়েছে। সেই সুযোগে তারা তাদের মতো করে চুক্তি করেছে এ দেশের নীতিনির্ধারকদের দিয়ে। আমাদের দেশে কর ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এটা হতে পারে না। একটি বড় টেলিফোন প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪৫০ জন লোক নিয়ে কাজ করছে। তারা আমাদের মানুষের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। আমি যদি জামাই আদর না করি তবে সে আসবে না, এটা ভাবার সময় এখন আর নেই। এখন চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়ন বা বাতিল করা উচিত।'

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা বলেন, 'চুক্তি থেকে কীভাবে সুবিধা নিতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা দরকার। আমরা অনেক ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম না।' বাংলাদেশ বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করা। তা হয়নি। উল্টো তারা টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান কিংবা দক্ষতা বৃদ্ধিতে কতটা কাজে আসছে তা বিবেচনায় নিতে হবে।'

কী করা যেতে পারে এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'জাতিসংঘের বা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার যে নীতিমালা আছে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, তা যদি আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ফাঁকির পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে। একটি আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে করতে হবে। তা না হলে অন্য দেশ সুযোগ বেশি দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে যাবে। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থাকলে এবং সবাই তা মানলে কর আদায় বাড়ানো যাবে।

তথ্যসূত্র : সমকাল

About Author

Profile Picture

Golden Bangladesh

Golden Bangladesh is a point of access to information.We present information from diverse sources in a unified way. It is the leading web portal, e-Directory and business guide in Bangladesh.

Leave a Comment