স্থবিরতা কাটানোর পথে জাহাজনির্মাণ শিল্প

স্থবিরতা কাটানোর পথে জাহাজনির্মাণ শিল্প

ঋণসংকট থেকে বেরিয়ে আসছে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ের মতো ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতিগুলো। এরাই বাংলাদেশে নির্মিত নতুন জাহাজের বড় ক্রেতা। আবার আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া, মোজাম্বিক ও কেনিয়ার ক্রেতারা যোগাযোগ শুরু করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। আবার সাগরে স্থাপিত রিগে ব্যবহারের জন্য সাহায্যকারী জাহাজের চাহিদা এখন বাড়ছে।
সব মিলিয়ে মন্দার কারণে স্থবির হয়ে থাকা জাহাজনির্মাণ শিল্পে এখন এসব আশার আলো হাতছানি দিচ্ছে। রপ্তানি আয়ের উদীয়মান খাত হিসেবে কয়েক বছর আগেই চিহ্নিত হয়েছে জাহাজনির্মাণ খাত। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা শুরুর আগেই আসতে থাকে জাহাজ রপ্তানির কার্যাদেশ। চুক্তিও হয়েছে হাজার কোটি টাকার। বিশ্বমন্দার প্রভাব শুরুতে না পড়লেও ২০১০ সালের ইউরোপের ঋণসংকট এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশি ক্রেতারা জাহাজের ক্রয়াদেশ দিলেও, আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়ে অনেকগুলো বাতিল করে দেয়। এতে প্রায় ২০ কোটি ডলার কার্যাদেশও আটকে যায়। আর গত দুই বছরে কার্যত নতুন কোনো রপ্তানি আদেশ আসেনি।
উদ্যোক্তারা জানান, মন্দার কারণে ছোট জাহাজের বাজারে যে ধীরগতি ছিল, তা শিগগিরই কেটে যাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা সে দেশের ব্যাংকের সহযোগিতা পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে নতুন রপ্তানি আদেশ দিতে যোগাযোগ শুরু করেছেন ইউরোপের ক্রেতারা। আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতেও চোখ রাখছেন উদ্যোক্তারা। আগামী বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা। বছরের প্রথম প্রান্তিকেই এসব রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করবে বলে ধারণা এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠনটির।
স্থবির হয়ে পড়া এই খাতে নতুন আদেশ কাজে লাগাতে বিশেষ তহবিল গঠনের কথা বলছেন উদ্যোক্তারা, যেন এ তহবিল থেকে স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া যায়। শুরুর দিকে সরকার ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলেও নানা জটিলতায় এক টাকাও ছাড় পাননি জাহাজনির্মাতারা। এরই মধ্যে ব্যাংক সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আরও কঠিন বাধার মুখে পড়ছে উদীয়মান এই খাতটি। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংক অর্থায়নে কড়াকড়ি আরোপ করায় আর্থিক অনিশ্চয়তাই এখন বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জাহাজের ক্রেতাদেশগুলো মন্দা থেকে ঘুড়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে এখন কম সুদে ঋণের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা উচিত। কারণ, মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত চীন ও ভারতের উদ্যোক্তাদের বিশেষ ভর্তুকি দিয়েছে সে দেশের সরকার।’
উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলো থেকে রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করে। ২০০৮ সালে মে মাসে সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে এই খাতে নাম লেখায় বাংলাদেশ। ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড এবং চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের হাত ধরে মূলত এই খাতে রপ্তানির বাজার প্রসারিত হতে শুরু করে। এ সময় ডেনমার্ক, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, পাকিস্তান, মোজাম্বিকে জাহাজ রপ্তানি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৮৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৬৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রপ্তানি আয় হয় এ খাত থেকে। মন্দার প্রভাবে গত বছর রপ্তানি আয় কমে আসে। মাত্র ৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকার রপ্তানি আয় আসে গত অর্থবছর এ খাত থেকে। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে একটি ফেরি রপ্তানি বাবদ এই অর্থ আয় করে।
স্থবির হয়ে পড়া এ খাতটি এখন সরকারি-বেসরকারি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জাহাজনির্মাণের চাহিদা পূরণ করে টিকে আছে। এর মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী জাহাজ, রো রো ফেরি, তেল পরিবহনের জাহাজ, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার এবং ছোট আকারের কনটেইনার জাহাজ। আগে বিদেশ থেকে কিনে আনা এ ধরনের জাহাজ এখন দেশে নির্মিত হওয়ায় বিদেশি মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে। আগামী বছরের মধ্যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এই বাজারের চাহিদা পূরণ করবে জাহাজনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
জাহাজনির্মাতা প্রতিষ্ঠান এফএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইয়াছিন চৌধুরী মনে করেন, ‘চাহিদা থাকলেও মন্দার কারণে ছোট জাহাজের ক্রয়াদেশ দেওয়ার ব্যাপারে ধীরগতি ছিল বিদেশি ক্রেতাদের। আর্থিক নিশ্চয়তা না পাওয়ায় আমারও রপ্তানি আদেশ নিতে সাহস পাইনি। আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে এ অবস্থা থাকছে না। সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।’
উদ্যোক্তাদের মতে, আগামী তিন বছরের বিশ্বে জাহাজের বাজার প্রসারিত হবে। আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থার বাধ্যবাধকতায় ‘সিঙ্গেল হাল’-এর জাহাজ চলাচলে বিধিনিষেধ আসছে। পুরোনো এসব জাহাজ প্রতিস্থাপন করতে হবে। আবার পরিবেশের দূষণমুক্ত জাহাজ তৈরির ধারণাও প্রসার হচ্ছে। তেল থেকে এলএনজি গ্যাসে চালিত জাহাজের কদর বাড়বে এ সময়। এই বড় বাজারের সুযোগ লাভ করতে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
উদ্যোক্তারা জানান, দেশীয় এখন ১০টি শিপইয়ার্ড রপ্তানিযোগ্য জাহাজ বানাতে সক্ষম। এই সংখ্যা যত বাড়বে, ততই বাংলাদেশে জাহাজ বানানোর বড় বাজার তৈরি হবে।

প্রথম আলো: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩

About Author

Profile Picture

Golden Bangladesh

Golden Bangladesh is a point of access to information.We present information from diverse sources in a unified way. It is the leading web portal, e-Directory and business guide in Bangladesh.

Leave a Comment